ছিপছিপে চেহারা নিয়েও বুকে ছিল বডি বিল্ডার হওয়ার স্বপ্ন , পালিত হচ্ছে কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষের জন্মদিন

নভেম্বর ২৪, ২০২২ রাত ০৮:০৭ IST
637f6890c12ea_79383813

নিজস্ব প্রতিনিধি , কলকাতা - বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের কথা স্মরণ করলেই চলচ্চিত্র জগতের জনক সত্যজিৎ রায়ের পরেই যার কথা মাথায় আসে তিনি আর কেউ নন কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষ । আজও প্রতিটা বাঙালি বাড়ির কাজে জর্জরিত হলেই সেই গৃহকর্মে নিপুণ ধনঞ্জয়ের কথাই সর্ব প্রথম মনে উদিত হয়। হাজারো অভিনেতাদের অনুপ্রেরণা সত্যজিৎ রায়ের বাঘার আজ ৯১তম জন্মবার্ষিকী । বিশিষ্ট অভিনেতার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ স্মৃতির পাতা উল্টাচ্ছেন তার বহু অনুরাগীবৃন্দরা।

বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক চিরস্মরণীয় নক্ষত্র রূপে রবি ঘোষ সমগ্র বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আশীর্বাদ স্বরূপ উপনীত হয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলা ছবিতে চিরন্তন শিল্পকলা রূপে উপস্থাপিত করেছিলেন । তার অনবদ্য অভিনয় মানুষের প্রাণ ছুয়ে যাওয়ার পাশাপাশি রোজকারের ব্যস্ততাময় জীবনে সকলকে হাসার রসদ জুগিয়েছিলেন । তিনি অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের মধ্যে যেভাবে হাস্যরসাত্মক বোধকে চাগিয়ে তুলতেন তা একেবারেই অকল্পনীয়।

কালজয়ী এই অভিনেতা মৃণাল সেন পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের অভিনয় দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে তার ওই স্বল্পক্ষণের অভিনয়ের মুগ্ধতাই তাকে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ইতিহাস গড়তে এক পা এগিয়ে নিয়ে যায় । এরপর সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ অনুসারে কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষ অন্য এক বিশিষ্ট অভিনেতা উৎপল দত্তের নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত হন।

এরপর তার জীবনে চরম এক শোকের অন্ধকার নেমে আসেন । তিনি তার বাবাকে হারান । কিন্তু শোকস্তব্ধ অবস্থাতেই নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে তার পাঁচ দিন পরেই উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজির নিবেদনে ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শোতে অভিনয় করেন । কিন্তু ওই বিধ্বস্ত মানসিক পরিস্থিতির ছাপ কোনোভাবেই তার অভিনয়ে ফুটিয়ে উঠতে দেননি।

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই অভিনেতা সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির খ্যাতনামা পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম তরুণ মজুমদার থেকে শুরু করে সন্দীপ রায়, গৌতম ঘোষ, মৃণাল সেন, অঞ্জন চৌধুরী, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কাজ করেছেন । সেইযুগে সিনেমাতে সকলের মুখে শুধু মুখ্য চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেতা অভিনেত্রীদেরই নামই উচ্চারিত হত । কিন্তু তিনি যেসব সিনেমায় তার উপস্থিতি রেখেছিলেন সেখানে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেতা অভিনেত্রী দিন পাশাপাশি তার নামও মুখরিত হত।

মূলত তার হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে হাস্যকৌতুকের জন্ম । তবে ব্যঙ্গাত্মক চরিত্র ছাড়াও তাকে বহু সাবলীল চরিত্রেও প্রস্ফুটিত হয়ে দেখা গেছে । সবচেয়ে গর্বের বিষয় হল হিন্দী চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনও তার অভিনয়ের পরম ভক্ত ছিলেন । এক কথায় বলতে গেলে সব চরিত্রই অবলীলায় দর্শকদের সামনে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন এই অভিনেতা।

জনপ্রিয় এই অভিনেতার পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পরবর্তীতে রবি ঘোষ নামে পরিচিতি পান। ১৯৪৯ সালে সাউথ সাবার্বান মেইন স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাশ করে আশুতোষ কলেজে গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হন। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। এরপর ১৯৫৩-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কাজ করেন।

লোকমুখে শোনা যায় তার শরীরের প্রতিটা রন্ধে রন্ধ্রে অভিনয়ের প্রতি মাদকতা থাকলেও শরীরচর্চাই ছিল তার একমাত্র নেশা । তিনি তার কর্মজীবনের শুরুতে বডিবিল্ডার হতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাকে হয়ে যান কিংবদন্তি অভিনেতা । তার এই সিদ্ধান্তই বাংলা চলচ্চিত্রকে কিছু অসাধারণ নিদর্শন উপহার দিয়েছে । তাঁর বাবা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার ছিলেন পূর্ব বাংলার বরিশালের গাভার বাসিন্দা।

চাকরি-সূত্রে কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে থাকতেন। তার মুখ থেকেই বহুবারই শোনা গেছে তাঁর বাবা অভিনয় পেশাটিকে একেবারেই অপছন্দ করলেও তিনি তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়েই মূলত তার অ্যাক্টিং ক্যারিয়ারের সূত্রপাত করেন । তবে এই পুরো সময়ে তিনি তার মাকে সর্বদা তার পাশেই পেয়েছিলেন।

শুনলে অবাক লাগতে পারে হারগিলগিলে চেহারার বাঘা নাকি বাস্তব জীবনে একজন খাদ্য রসিক ব্যক্তি ছিলেন । প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল লুচিও পাঁঠার মাংস । তবে খেতে পছন্দ করলেও মাপ যোগ করেই সর্বদা আহার করতেন । এছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি সকলকে খাওয়াতেও অত্যন্ত পছন্দ করতেন।

তার সব ছবিগুলোর মধ্যে ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘আরণ্যের দিনরাত্রি’র মত ছবিগুলো আজকালকার জেনারেশনও সমানভাবেই উপভোগ করে থাকে।

হাস্যরসের মাধ্যমে বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে তুলে ধরার মতো অনবদ্য ক্ষমতা অতি সহজেই দর্শকদের মন কেড়েছে । এখানেই শেষ নয় । মঞ্চাভিনেতা থাকাকালীন বিশিষ্ট এই শিল্পী ‘চলাচল’ নামে নিজের এক নায়কের দলে শুরু করেছিলেন । তিনি প্রথমে বিয়ে করেন অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে যার অকাল মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেননি । তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ১০ বছর পর ফের বিয়ে করেন বৈশাখী দেবীকে । ১৯৯৭ সালের ৪ ই ফেব্রুয়ারি কিংবদন্তি এই অভিনেতা মৃত্যুর দেশে পাড়ি জমান । যার মৃত্যুর অনেক যুগ অতিবাহিত হলেও তিনি মানুষের মনে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়ে গেছেন।

১৯৩১ সালে আজকের দিনে কোচবিহারের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অভিনেতা রবি ঘোষ । আজ জনপ্রিয় এই অভিনেতা ৯১তম বর্ষের পদার্পণ করলেন । তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চলচ্চিত্র জগতের সমস্ত তারকাবৃন্দ থেকে শুরু করে তার অনুরাগীরাও আজকের দিনে তার সেইসব উজ্জ্বল দিলগুলির কথা মনে করে স্মৃতিচারণা করছেন ।

ভিডিয়ো

Kitchen accessories online