অমৃতবাজার এক্সক্লুসিভ, ইন্দ্রজিৎ আইচ - তারাপদ রায়ের গল্প অবলম্বনে দেবাশিস সেনগুপ্ত নির্দেশিত এবং বেলঘরিয়া এথিক প্রযোজিত নাটক 'কে ডাকে?' সম্প্রতি গিরিশমঞ্চে মঞ্চস্থ হলো। নাটকটি কোনও এক কাল্পনিক শহরে, কোনও এক কাল্পনিক সময়ের কথা বলে। নাটকের সময়কাল ভবিষ্যৎ এবং প্রেক্ষাপট কাল্পনিক হলেও নাটক কথা বলে বর্তমান এবং তার গভীর অসুখ নিয়ে।

নাটকের শুরুতেই সূত্রধর জানিয়ে দিয়ে যান যে এই নাটকের মুখ্য চরিত্র সদাব্রত সান্যাল। তিনি এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তার এই সমস্যা ও সেই সমস্যার উৎসসন্ধানই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রথমেই আমরা জানতে পারি সদাব্রত সান্যাল ভবিষ্যতের এমন এক শহরে থাকেন উন্নতির লক্ষণ হিসেবে যে শহরকে সম্পূর্ন গাছ-পালা-পশু-পাখি মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তার নিজের ঘরে একা হলেই তিনি এক অজানা পাখির ডাক শুনতে পান। ক্লান্ত বিপর্যন্ত সদাব্রতকে তার সানফ্রানসিস্কোস্থ ছেলে ঠিকানা দেয় সাইকিয়াট্রিস্টের।

এরপর এক দীর্ঘ আর কষ্টকর প্রক্রিয়া চলতে থাকে সদাব্রতর স্মৃতি থেকে পাখির ডাক মুছে ফেলার জন্য। সদাব্রত ক্রমশ বুঝতে পারেন যে তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। সদাব্রতও জানেন - 'যে ডাক বেশীরভাগ মানুষ শুনতে পায় না, সেই ডাক যারা শোনে, তারাই আসলে পাগল'। তাই সদাব্রত খুঁজে বেড়ান সেই মানুষকে, যে তারই মতো শুনতে পায় ডাক। আসলে 'ডাক' এক মেটাফর, যার আড়ালে নাটক খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া জীবন আর নিঃসঙ্গে বয়ে চলা হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাকে। এই খোঁজার পথে তার সঙ্গে দেখা হয় এক যুবকের, যাকে তার চেনা চেনা লাগে, কিন্তু... সেই যুবকের সঙ্গে সম্পর্কের রেশ ধরেই ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে ডাক-রহস্য।

এতো গেল গল্পের কথা। এই নাটকের মূল বিশেষত্ব তার উপস্থাপনা। ছোট ছোট দৃশ্যের ব্যাবধানে মঞ্চে গল্পটা মূলত বলে একদল ছেলেমেয়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে, মঞ্চ সাজাতে সাজাতে, ছড়া বলতে-বলতে, টিকা-টিপ্পনি কাটতে-কাটতে। তারাই এই নাটকের সূত্রধার, প্রাণ এবং সোহেল হকের নেতৃত্বে - অর্ণব, ঋত্বিক, রানু, এষণা, কুশল, প্রিয়াঙ্কা, বনি, সুব্রত, গৌতম, দীপাঞ্জনদের মত এক ঝাঁক তরুণ মঞ্চজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়। আধুনিক নাটকের প্রবনতায় মঞ্চ-উপকরণের ব্যাবহার মিনিমালিস্টিক। সূত্রধারেরা তাদের ব্যবহৃত অভিনয়-উপকরণের সাহায্যেই অসামান্য কিছু দৃশ্য-মুহূর্ত সৃষ্টি করেন মঞ্চে। গল্পের চরিত্রগুলো রূপ পায় শান্তনু দাস, চন্দ্রানী ঘোষ, সুরঞ্জনা দাস, সৌমেন দাস, মৃত্যুঞ্জয় রায়, তাপস সরকার এবং কাকলি মজুমদারদের মতো দলের অভিজ্ঞ অভিনেতাদের উপস্থিতিতে। সদাব্রতর চরিত্র নাটককার-পরিচালক দেবাশিস সেনগুপ্তর অভিনয়ে অন্য মাত্রা পায়, এই নাটকে।

সৌমেন চক্রবর্তীর আলো, অমিত ঘোষের শব্দ প্রক্ষেপন নাটকের গতিকে ধরে রাখার জন্য যথাযথ। কাকলি মজুমদার পরিকল্পিত পোশাক এবং বাপ্পাদিত্য প্রামানিকের রূপসাজ পরীক্ষাধর্মী এবং আকর্ষণীয়। নাটক শেষ হয় এক বাস্তবোত্তর দৃশ্য ভাবনায়, ভেসে আসতে থাকে তীর্থ ভট্টাচার্যের স্বরের আকুতি- জানিনা খাঁচার ভিতর পাখি তুই আছিস কি না...একঝাঁক তরুনকে মঞ্চ চেনানর জন্য পরিকল্পিত প্রযোজনা, তাই আরো অনুশীলন ও উন্নতির সুযোগ ও প্রয়োজন আছেই, কিন্তু পাগলা ঘোড়া, লাইল্যাক তোমাকে, খনন আদি, কে ডাকে?... বেলঘরিয়া এথিক-এর পরপর প্রযোজনা দেখলে বোঝা যায় তারা ক্রমাগত নতুন ও আরও নতুন নাটক এবং নাট্যভাষার পরীক্ষা ও খোঁজ করে চলেছেন। সব মিলিয়ে সবার দেখার মতো একটি প্রযোজনা।