সকাল সাড়ে আটটার সময়ে সারি গ্রামকে বিদায় জানিয়ে আমরা এবার চোপতার পথে রওনা দিলাম । এখান থেকে চোপতার বেশী দূরে নয় দূরত্ব কেবল মাত্র ২২ কিলোমিটার । আগের দিন ভোর রাত্রিতে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিলো তাই বেশ ঠান্ডা লাগছিলো । পথ চলতে চলতে চোখে পড়লো সবুজ ঘাসের উপর শ্বেত – শুভ্র তুষার, আগের দিন ভোর রাত্রিতে বৃষ্টির পরেই মনে হয় তুষারপাত হয়েছিলো । ভোরবেলার আকাশও মেঘে ঢাকা থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ সরে গিয়ে দেখা পেলাম সূর্যদেবের এবং তারসাথে দেখা পেলাম পরিষ্কার নীল আকাশ । সকালের ভোরের হাওয়াতে গাড়িতে পথ চলতে চলতে প্রকৃতির অপরূপ শোভা উপভোগ করতে করতে কখন যে চোপতা মার্কেটের সামনে এসে হাজির হয়েছি তা বুঝতেই পারিনি । এখান থেকেই হাঁটা পথে আমদের তুঙ্গনাথ যেতে হবে । সময় নষ্ট না করে গাড়ি থেকে আমাদের মালপত্র সব নামিয়ে নিয়ে গাড়িওয়ালাকে ছেড়ে দিলাম । এখানেই একটা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে নিলাম । পরের দিন ভোরবেলাতে আমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলাম তুঙ্গনাথের পথে পা বড়াবো বলে, আমাদের দলের দুইজন ঘোড়া করে রওনা দিলেন এবং বাকী তিনজন আমরা হাঁটা পথে তুঙ্গনাথের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । পথ চলার শুরুতেই বাঁদিকে চোখ পড়তেই দূরে দেখতে পেলাম কেদার, চৌখাম্বা, ভাগীরথী বিভিন্ন শৃঙ্গ । পথ চলার পথে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে মনটা এক নাম না জানা অচিনপুরে হারিয়ে যায়। পথের দুই ধারে সবুজ বনানী ঘেরা, এখানে আছে রডোডেনড্রনের গাছ । এপ্রিল – মে মাসে রডোডেনড্রনের ফুল ফুটলে এই পথের প্রাকৃতিক শোভা আরো বৃদ্ধি পেয়ে যায় । এখানে পথ অনেকটাই চড়াই আছে, তাই পথ চলার মাঝে কোনো জায়গাতে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে পথ চলতে হয় । পথ চলার মাঝে মাঝে অনেক জায়গাতে বসার জায়গা আছে । তারসাথে চোখে পড়বে সবুজ রঙের চাদরে ঘেরা ভ্যালি বা উপত্যকা । আমরা পথ চলা শুরু করেছিলাম সকাল সাড়ে সাতটার সময়ে এবং ঠিক সাড়ে দশটার সময়ে তুঙ্গনাথে পৌঁছে ছিলাম । তুঙ্গনাথের এই হাঁটা পথ প্রায় ৩.৫ কিলোমিটারের মতো হবে । পঞ্চকেদারের মধ্যে তুঙ্গনাথ হলো গাড়োয়ালের সর্বোচ্চ কেদার মন্দির এবং এখানকার উচ্চতা ১২,০৭২ ফুট । তুঙ্গনাথে মহাদেবের বাহু প্রকাশিত হয়েছে । গর্ভমন্দিরের ভিতর লিঙ্গ মূর্তি এবং লিঙ্গ মূর্তির পিছনেই আছে শঙ্করাচার্যের তৈলচিত্র । বাঁ দিকে আছে কালভৈরব,ডানদিকে আছেন ঋষি বেদব্যাস, আর আছে শিলামূর্তি । এই মন্দির প্রস্তর দিয়ে নির্মিত, মন্দিরের গায়ে সুন্দর কারুকার্য আছে । মন্দিরের চূড়াতে আছে তামার পাতে সোনার প্রলেপ। মন্দিরের সামনের দিক বাঁধানো আছে । একপাশে আছেন পাঁচ ঈশ্বরীমাতা, আছেন ভগবান বিষ্ণু, গৌরীশঙ্কর পিতৃদেব ও ভৈরবনাথ । এছাড়া এখানে আছে কয়েকটি পাকা ঘর, যেখানে আছে পূজারীদের থাকার ঘর এবং তুঙ্গনাথ মন্দিরের ভান্ডার ঘর ।
এখানে একরাত থেকে পরের দিন ভোরবেলাতে বেড়িয়ে পড়তে হয় চন্দ্রশিলার উদ্দেশ্যে । মন্দিরের পিছন দিয়ে রাস্তা আছে চন্দ্রশিলা যাওয়ার জন্য, তবে ভোরবেলা এখানে যেতে গেলে সাথে গাইড অবশ্যই নিয়ে নিলে ভালো হয় , এখানকার পথ অনেকটাই কঠিন পথ । ভোরবেলা চন্দ্রশিলা থেকে সূর্যদয়ের অপরূপ সৌন্দর্য্য এক অবর্ননীয় দৃশ্য, এই অপরূপ শোভা যারা দেখেছেন তাদের মনিকোঠায় আজীবন থেকে যাবে । যদি আকাশ মেঘমুক্ত থাকে তবেই এই অপরূপ দৃশ্যকে উপভোগ করা যায় । কামেট শৃঙ্গের উপর দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো লাল করে দেয় নন্দাদেবীর চূড়া, তারপর সেই আলোর কিরন ছড়িয় পড়ে গাড়োয়াল – কুমায়নের সবকটি চূড়াতে । সামনে দাঁড়িয়ে থাকে স্বমহিমায় চৌখাম্বা শৃঙ্গ । এই দৃশ্য সমস্ত ভ্রমনপিপাসু মানুষকে মুগ্ধ করে । কথিত আছে চন্দ্রশিলাতে বসে নাকি রামচন্দ্র তপস্যা করেছিলেন ।
কালীপূজোর পরে অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য তুঙ্গনাথের মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায় । তখন এখানকার দেবতা পূজিত হন মুকুমঠে । আবার মে মাসের ৭ – ১৫ তারিখের কোনো একটা দিনে তুঙ্গনাথে আবার দেবতাকে ফিরিয়ে আনা হয় ।
কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার হয়ে গাড়ি ঠিক করে নিয়ে উখিমঠে পৌঁছে এখানে একরাত থেকে পরের দিন সারি গ্রামে আসা যেতে পারে। চোপতায় এসে তুঙ্গনাথে রওনা দিয়ে তুঙ্গনাথে একরাত থেকে চন্দ্রশিলা দর্শন করে নেওয়া যেতে পারে ।